আওয়াজ ডেস্ক: নির্মাণাধীন একটি ভবনের চারতলার রড ধরে ঝুলে আছেন একজন তরুণ; তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করছে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি ভিডিও ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়েছে।
সেই তরুণ বেঁচে আছেন। তাঁর নাম আমির হোসেন (১৮)। তিনি বলেন, ‘ঘুমের মধ্যে এখনো স্বপ্নে দেখি, পুলিশ আমাকে গুলি করছে।’
নির্মাণাধীন ভবনটি রামপুরার মেরাদিয়ার। গত ১৯ জুলাই সেখানে গুলিবিদ্ধ হন আমির। তিনি জানান, একজন শিক্ষার্থী ও দুজন চিকিৎসক তাঁকে উদ্ধার করেন। তারপর স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।
আমিরের দুই পায়ে মোট ছয়টি গুলি করেছে পুলিশ। গুলিগুলো এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন তাঁকে বিছানায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। রোববার মেরাদিয়ায় নয়াপাড়ায় আমিরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, দুই পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি।
আমিরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে। ছয়-সাত বছর আগে মাকে হারিয়ে তাঁরা তিন ভাই-বোন ঢাকায় চলে আসেন। বাবা বিল্লাল মিয়া গ্রামে অটোরিকশা চালান। নয়াপাড়ায় একটি টিনশেড বাসায় তিন ভাই-বোন থাকেন।
আমিরের বাসাটি এখন মেরাদিয়া এলাকার অনেকেই চেনেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মেরাদিয়ায় গিয়ে পাঁচজন রিকশাচালক ও দোকানদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ঝুলে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়া লোকটির বাসা কোথায়। তিনজন আমিরের ঘটনাটি জানেন। তাঁর বাসা কোথায়, তা-ও জানান।
গিয়ে দেখা যায়, একটি আধা পাকা বাড়ির দুটি কক্ষ নিয়ে থাকেন আমির ও তাঁর ভাই-বোন। আমির আফতাবনগরে একটি দোকানের কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। তাঁর বড় ভাই নয়ন মিয়া পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আমির ও তাঁর ভাইয়ের আয়ে তিনজনের সংসার চলে। বোন সবার ছোট। তার নাম হাসনা (১৬)।
১৯ জুলাই কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, বিক্ষোভের কারণে দোকান বন্ধ ছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার। তিনি জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন। বাসার কাছেই পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যান তিনি। পুলিশ গুলি শুরু করে। তিনি দৌড়ে নির্মাণাধীন ভবনটির চারতলায় গিয়ে আশ্রয় নেন।
আমিরের ভাষ্য, একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে পুলিশ ভবনটির চারতলায় উঠে যায়। সেখানে তাঁকে পেয়ে যায়। পুলিশের সদস্যরা তাঁর দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে বারবার নিচে লাফ দিতে বলেন। একজন পুলিশ সদস্য তাঁকে ভয় দেখাতে কয়েকটি গুলিও করেন। একপর্যায়ে ভয়ে তিনি লাফ দিয়ে নির্মাণাধীন ভবনটির রড ধরে ঝুলে থাকেন।
আমির বলেন, তিনি যখন ঝুলে ছিলেন, তখন তৃতীয় তলা থেকে একজন পুলিশ সদস্য তাঁকে লক্ষ্য করে ছয়টি গুলি করেন। গুলিগুলো তাঁর দুই পায়ে লাগে। একপর্যায়ে পুলিশ চলে যায়, তিনি ঝুলে ছিলেন। পরে তিনি ঝাঁপ দিয়ে কোনোরকমে তৃতীয় তলায় পড়েন। সেখানে দুই পা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। প্রায় তিন ঘণ্টা পর তাঁকে উদ্ধার করেন একজন শিক্ষার্থী ও দুই চিকিৎসক।
চিকিৎসক দুজন স্থানীয় ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতালের। তাঁদের ডেকে এনেছিলেন ওই শিক্ষার্থী। আমির তাঁদের নাম জানেন না। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ঢাকা মেডিকেল থেকে তিন মাসের ওষুধ লিখে দিয়ে তাঁকে বাসায় পাঠানো হয়।
আমির বলেন, তিনি এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া শৌচাগারেও যেতে পারেন না। দিনের বেলায় পায়ে তেমন ব্যথা থাকে না। তবে রাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথার কারণে ঘুম তেমন একটা হয় না। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে তিন মাস বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কিন্তু চাকরি না করে কীভাবে নিজের চিকিৎসা করাবেন, সংসার চলবে কীভাবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
আমির বলেন, তিনি আর কখনো আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারবেন কি না, সেটা নিশ্চিত নন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গত ১৬ জুলাই। ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কোটা সংস্কার, সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এখন পর্যন্ত মোট ৬২৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
কত মানুষ আহত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের ধারণা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি হাসপাতালে ৪৩৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাঁদের ১০ জনের পা কাটা গেছে, ১ জনের এক হাত কাটা গেছে। অনেকের হাতে, পায়ে বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর ক্ষত আছে। ৩২ জনের চোখে আছে ছররা গুলির আঘাত।
সরকার আহত ব্যক্তিদের বিনা খরচে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। তবে অনেকে আগেই নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। এখন ওষুধ ও পথ্য কিনতে হচ্ছে। তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে নিম্ন আয়ের আহত মানুষের জীবনে দুর্দশা নেমে এসেছে।
আমিরের বড় ভাই নয়ন মিয়া বলেন, দুই ভাইয়ের উপার্জনের টাকায় খুব কষ্টে সংসার চলে তাঁদের। ছোট ভাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তাঁর একার উপার্জনের টাকায় ছোট ভাইয়ের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
For more information
আরো দেখুন|
Summary
Article Name
ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ছয় গুলি, সেই তরুণ বেঁচে আছেন
Description
নির্মাণাধীন একটি ভবনের চারতলার রড ধরে ঝুলে আছেন একজন তরুণ; তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করছে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে...
Author
sylheterawaz
Publisher Name
sylheterawaz
Publisher Logo