মামলায় যা উল্লেখ করেন বাদী
টিলাগড় শাপলাবাগ এলাকার বাসিন্দা রেখা খাতুন চৌধুরী গত ৭ নভেম্বর কতোয়ালী থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। যাতে তিনি উল্লেখ করেন, ছেলে এহসানুল হক চৌধুরীকে আরওয়ান ৫ মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৬ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে বাসা থেকে বের হন। বাসা থেকে সঙ্গে নেন ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর নগরীর সোবহানীঘাটস্থ আল হারামাইন হাসপাতালে তার ভাসুর প্রখ্যাত শিশু চিকিৎসক মসিহ উদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে আরো ২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। সর্বমোট ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা ( সিলেট-থ-১২-০১৯১/ সিলেট-থ-১২-০১৯৯) চড়ে মদীনা মার্কেটে অবস্থানরত তার স্বামী এসআই এনামুল হক চৌধুরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ওই সিএনজি অটোরিকশার পেছনে আরবীতে আল্লাহু ও বাংলায় আনোয়ার পরিবহন লেখা ছিল। সিএনজি অটোরিকশাটি সুবিদবাজার পয়েন্টে যাওয়া মাত্র চালক উল্টো দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে সাগরদিঘীরপাড় এলাকায় নিয়ে গিয়ে চালক আত্মীয় পরিচয় দিয়ে দুই যুবককে গাড়িতে তুলে। এরপর ওই দুই যুবক চাকু ধরে রেখা খাতুন চৌধুরীর সঙ্গে থাকা ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এরকম একটি এজাহার পাওয়ার পর তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তের দায়িত্ব পান কতোয়ালী থানার সাব ইন্সপেক্টর এ এইচ এম রাশেদ ফজল। এরআগে পুলিশ এজাহারটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। যার নং ১১ (০৭-১১-২০২৩)। এরপর গাড়ির নাম্বার না মিললেও গাড়ির পেছনে আনোয়ার পরিবহন লেখা রয়েছে এমন তথ্যের উপর ভিত্তি করে ৮ নভেম্বর সিলেট শহরতলীর ঘোপাল গ্রামে অভিযান চালায় পুলিশ। তখন আনোয়ার পরিবহন লেখা (সিলেট-থ-১২-৩১৯১) গাড়িটি জব্দ করা হয়। এসময় গাড়ির চালক ঘোপাল গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের পুত্র ফুল মিয়া উরফে কাজলকে সন্দেহজনকভাবে ধরে নিয়ে আসে পুলিশ।
আটক কাজলের স্বজনদের দাবি
পুলিশ কাজলকে ধরে নিয়ে আসার পর তার স্বজনরা দ্রুত কতোয়ালী থানায় ছুটে আসেন। তার মামা ছমির আলী জানান, তাদের সামনেই বাদী রেখা খাতুন চৌধুরীর মুখোমুখী করা হয় কাজলকে। তখন রেখা খাতুন চৌধুরী ওই গাড়ির চালক যে কাজল ছিলেন তা সনাক্ত করেন। কাজলও ওই মহিলা কোথায় থেকে গাড়িতে উঠেছিলেন সব জানান।
কাজলের বরাত দিয়ে সঙ্গে থাকা কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাবাজ আহমদ জানান, কাজল পুলিশকে জানায়, ওই মহিলা সোবহানীঘাট আল হারামাইন হাসপাতালের সম্মুখ থেকে তার গাড়িতে উঠার যে তথ্য দিয়েছেন, তা ভুল। মূলতঃ তিনি নগীরর সিটি পয়েন্ট থেকে তার গাড়িতে উঠে পাঠানটুলা পয়েন্টে ফুলকলি’র সামনে গিয়ে নামেন। এসময় তিনি তার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই ফুলকলিতে ঢুকেন। সাবাজ আরো জানান, এরপর তদন্ত কর্মকর্তা রাশেদ ফজলকে অনুরোধ করেন পাঠানটুলা ফুলকলিতে গিয়ে তদন্তের জন্য। তখন সেখানে গিয়ে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে সত্যতা পাওয়া যায়। সিসি ফুটেজ সংগ্রহকালে মেম্বার সাবাজও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, কাজলের মামা ছমির আলী আরো দাবি করেন, প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় পুলিশ তখন গাড়িসহ কাজলকে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু পরে রহস্যজনক কারণে কাজলকে গ্রেফতার দেখিয়ে ৯ নভেম্বর আদালতে চালান দেয় পুলিশ। ছমির আলী দাবি করেন, সাগর দিঘীরপাড় যেখানে ছিনতাইর কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে চারদিকে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। পুলিশ চাইলেই ঘটনাটি যে সাজানো তা দ্রুততম সময়েই নিশ্চিত হতে পারতো। কিন্তু ‘উপরের চাপ আছে’ জানিয়ে আমার ভাগনাকে চালান দিয়ে দেয়।
অনুসন্ধান যা বলছে
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, একমাত্র ছেলে এহসানুল হক চৌধুরীকে আরওয়ান ৫ মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন রেখা খাতুন চৌধুরী। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার ছেলে এহসানুল হক চৌধুরীকে বাবা কিছুদিন আগে প্রায় দুই লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটি তার পছন্দ হয়নি। এরপর সে সাইকেলটি ১ লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি করে ওই টাকা বাবার হাতে তুলে দেয়। বাবা এসআই এনামুল হক চৌধুরী ছেলের সাইকেল বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করেন। এরপর মা রেখা ছেলেকে আরওয়ান ৫ মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার লক্ষ্যে চেষ্টা করছেন। এ জন্য স্বামীর কাছ থেকে বেশ টাকা পয়সাও নিয়েছেন রেখা। এরপর তিনি ছেলের সাইকেল কেনার টাকা ছিনতাই হয়েছে জানিয়ে মামলা করেন।
এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, ৭ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা নিজেদের কাছে রক্ষিত ছিল, অপর ২ লাখ টাকা তার ভাসুর ডা: মসিহ উদ্দিন চৌধুরীর সোবহানীঘাটস্থ আল হারামাইন হাসপাতালের চেম্বার থেকে সংগ্রহ করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডা: মসিহ উদ্দিন চৌধুরী গতকাল শুক্রবার রাতে দৈনিক সিলেটের ডাককে জানান, তার ভাতিজার মোটরসাইকেল কেনার টাকা ছিনতাইর ঘটনা তার জানা নেই। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রেখা খাতুন চৌধুরীও তার কাছে আসেননি, কোন টাকা-পয়সাও নেননি। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, কেউ কি চেম্বারে ২ লাখ টাকা নিয়ে বসে থাকে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেখা খাতুন চৌধুরী একজন সাব ইন্সপেক্টরের স্ত্রী পরিচয়ে বিভিন্নজনের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। তিনি অনটেস্ট সিএনজি অটোরিকশাসহ ভারত থেকে চোরাই পথে আসা মোটরসাইকেল ক্রয় বিক্রয়ের সঙ্গেও জড়িত রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট সদর উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জানান, কয়দিন আগে ওই মহিলা তাকে চোরাই পথে আনা একটি মোটরসাইকেল বিক্রির অফার দিয়েছিলেন। তিনি ওই সাইকেলের কাগজপত্র করে দেয়ার কথাও বলেছিলেন। পরে তিনি অনেকের সাথে কথা বলতে গিয়ে নিশ্চিত হন ওই মহিলা নানা প্রতারণার সাথে জড়িত।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, কয়দিন আগে রেখা খাতুন চৌধুরী ও তার স্বামী এনামুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে কমিশনার বরাবরে প্রতারণার লিখিত অভিযোগ করেন এক ভুক্তভোগী। পরে ওই বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ডিবির ইন্সপেক্টর আমিনুর রশীদের উপর। তিনি দৈনিক সিলেটের ডাককে জানান, ১ লাখ টাকার অভিযোগ ছিলো, ৬০ হাজার টাকা উদ্ধার করে দেয়া হয়েছে। বাকী টাকাও উদ্ধারে প্রক্রিয়াধীন।
সিএনজি অটোরিকশা চালক কাজলের মামা ছমির আলী অভিযোগ করেন, রেখা খাতুন চৌধুরী পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, যার জন্য থানা থেকে আমার ভাগনাকে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়ার পরও উল্টো তাকে চালান দেয়া হয়। তাকে দুই দিনের রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ।
কাজলের স্ত্রীর বক্তব্য
কারান্তরীণ ফুল মিয়া উরফে কাজলের স্ত্রী শেলি বেগম দৈনিক সিলেটের ডাককে জানান, তার স্বামী মামার বাড়িতে থাকেন। নিজেদের কোন ঘর বাড়ি নেই। সম্প্রতি আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরের জন্য নাম দেয়া হয়েছে। এখনো সেই ঘরে উঠেননি। তাদের ৩ সন্তান রয়েছে। স্বামী জেলে যাওয়ার পর থেকে তাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে মানুষের কাছে টাকা ঋণ করতে হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, তার স্বামীর কোন খারাপ রেকর্ড নেই, এরপরও কেন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল। তিনি বলেন, পুলিশ প্রথমে বললো ছেড়ে দেবে, এরপর জেলে পাঠিয়ে দিলো। এরজন্য তিনি আল্লাহর কাছে বিচার চান।
মামলার বাদী পক্ষের বক্তব্য
রেখা খাতুন চৌধুরী প্রথমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তার পক্ষে স্বামী সাব ইন্সপেক্টর এনামুল হক চৌধুরী কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, স্ত্রী ও সন্তানের অভিভাবক তিনি। তার একমাত্র ছেলে ৭ লাখ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনতেই পারে, এটা দোষের কিছু নয়। তিনি বলেন, আমার টাকা গেছে, আমার খারাপ লাগছে। আসামীর পরিবার দাবি করছে, আপনার স্ত্রী ঘটনা সাজিয়েছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সেটা আমি দেখবো আর পুলিশ দেখবে।
পরে রেখা খাতুন চৌধুরী সিলেটের ডাক এর ফোনে কল দিয়ে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, তার সব বক্তব্য মামলার এজাহারে রয়েছে। এরপর প্রতিবেদক তার ভাসুর ডা: মসিহ উদ্দিন চৌধুরী তাকে ২ লাখ টাকা দেননি এবং আল হারামাইন হাসপাতালে যাননি এমনটি বলেছেন বললে রেখা প্রতিবেদককে বলেন, আপনি উনাকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন কেন। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব পুরনো বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করছেন কেন? এরপর রেখা সিলেটের ডাক অফিসে আসছেন সরাসরি কথা বলতে জানিয়ে ফোন কেটে দেন। তবে তিনি আর অফিসে আসেননি।
শ্রমিক নেতার বক্তব্য
সিলেট জেলা সিএনজি অটো অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন ৭০৭ এর সভাপতি মো: জাকারিয়া বলেন, গ্রেফতার হওয়া সিএনজি অটোরিকশা চালক ফুল মিয়া উরফে কাজল একজন ভালো ছেলে। তার বিরুদ্ধে কখনো কোন অভিযোগ পাইনি। পুলিশের স্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলায় তাকে জেলে পাঠিয়ে দিলে অন্য চালকরা কি করবে? আমরা এর শক্ত প্রতিবাদ করবো। জাকারিয়া বলেন, চালক কাজলের মুক্তির দাবি ও ‘প্রতারক মহিলার’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে আমরা কর্মসূচি দেব।
পুলিশের ভাষ্য
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এ এইচ এম রাশেদ ফজল দাবি করেন, বিষয়টি তদন্তানাধীন। তাই তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজী নন। আর কতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ ফোন রিসিভ করেননি।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, পুলিশের একজন সাব ইন্সপেক্টর-এর স্ত্রী ছিনতাইর ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন। সেটি সত্য না মিথ্যা তদন্তে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। আসামী নিশ্চয়ই তদন্তে ন্যায় বিচার পাবে।
সৌজন্যে : সিলেটের ডাক