স্টাফ রিপোর্টার: কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি মৃত্যু হয়েছে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের। নিহত ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ।
হাসপাতাল, স্বজন ও মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের সূত্রে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বয়স, পেশা ও আঘাতের ধরন এবং কোন এলাকায় আহত অথবা নিহত হয়েছিলেন, তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে ১৫০ জনের। এর মধ্যে ১১৩ জন শিশু, কিশোর ও তরুণ।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিহতদের বেশির ভাগের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ছররা গুলি বা প্যালেট, রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন এবং অন্যান্য আঘাত কম। মৃত্যুর কারণ ও গুলির ধরন নিশ্চিত করতে ময়নাতদন্ত দরকার। অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হয়েছে, তবে প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ শুরু হয় ১৫ জুলাই। ওই দিন কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে (১৭ জুলাই কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি)। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যু হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল রোববার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৪৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ তাঁদের হিসাবে রয়েছে। তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপর যদি মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে সংখ্যাটি বাড়তে পারে। তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে যাঁরা ছাত্র, তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের ছেলেও রয়েছেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, বিভিন্ন বয়সের মানুষ রয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষও রয়েছেন। এসব বিষয় পরে বিস্তারিতভাবে জানানো যাবে।
সংঘর্ষ চলাকালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে এনেছিলেন বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষেরা। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশও তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে আসে। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই আহত ও নিহতের পরিচয়, বয়স ও পেশা সম্পর্কে জানতেন না। বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহতদের মধ্যে ১৯ জন শিশু ও কিশোর। এর মধ্যে চার বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে ৯৪ জন। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ২১ জন। ৪০ বা এর বেশি বয়স ১৬ জনের।
এই বিশ্লেষণে ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু এবং ২৯ বছর পর্যন্ত বয়সীদের তরুণ হিসেবে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুবা হিসেবে উল্লেখ করে এবং সাধারণভাবে তাঁদের তরুণ বলা যায় বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।
মৃত্যু বেশি হয়েছে ঢাকায়। ১৫০ জনের মধ্যে ৮৮ জনই ঢাকায় নিহত হয়েছেন। এরপর রয়েছে নরসিংদী (১৫), নারায়ণগঞ্জ (১৪), সাভার (৮), গাজীপুরসহ (৫) অন্যান্য জেলা।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে গণ–আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও তরুণেরাই বেশি অংশ নিয়েছেন এবং এবারও সেটাই হয়েছে বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে গেল, তখন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল। সর্বস্তরের মানুষ নেমে এসেছিলেন। তার মধ্যে কিছু লুটপাটকারী হয়তো ছিল, সেটা সব সময় থাকে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে সন্ত্রাসের কথা বলা হচ্ছে। মানুষ ক্ষুব্ধ কেন, সেটার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না।
মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, যুদ্ধের সময় ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে কোনো আন্দোলনে এতটা নির্বিচারভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়নি। এত অল্প সময়ে এত মৃত্যুও কখনো হয়নি।
যে ১৫০ জনের মৃত্যু বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন শিক্ষার্থী, যা ৩০ শতাংশ। নিহতদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।
পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আবু সাঈদ (২২), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২২), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসান হাবীব তামিম (২৩), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রুদ্র সেন (২২), মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন (২২), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ-২৬), নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের আসিফ হাসান (২১), ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৩), সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ইমতিয়াজ আহমেদ (জাবির-২৩), ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইরফান ভূঁইয়া (২১), মানারাত ইউনিভার্সিটির পারভেজ শাকিল (২২) প্রমুখ।
ঢাকায় কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক (২৩) ও জিহাদ হোসেন (২২) এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী (২৬) রয়েছেন নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
নিহত স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ফারহান ফাইয়াজ (রাতুল-১৭), সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাহামুদুর রহমান (১৯), ইমপেরিয়াল কলেজের জিল্লুর শেখ (১৭), মাইলস্টোন কলেজের নাইমা সুলতানা (১৫), মাদারীপুর সরকারি কলেজের দীপ্ত দে (২১), সরকারি শহীদ আসাদ কলেজের ইমন মিয়া (২২) প্রমুখ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় একাত্তর হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এরপর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। মারধর করা ছাত্রীদেরও। ১৬ জুলাই থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন।
For more information
আরো দেখুন|
Summary
Article Name
নিহত ১১৩ জন কম বয়সী, শিক্ষার্থী ৪৫
Description
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি মৃত্যু হয়েছে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের। নিহত ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ শিশু...
Author
sylheterawaz24
Publisher Name
sylheterawaz24
Publisher Logo