আওয়াজ ডেস্ক: ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা। ঢাকার শ্যামলী থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল একটি গোপন বন্দিশালায়, যেটি ‘আয়নাঘর’ নামে অনেকের কাছে পরিচিত।
কথিত ‘আয়নাঘরে’ বন্দি থাকার পর গত ৬ আগস্ট মাইকেল চাকমাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের কাছে চোখবাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। বন্দিদশা থেকে ফিরে জানতে পারেন, পুত্রশোক বুকে নিয়ে তার বৃদ্ধ পিতা মারা গেছেন। মাইকেল আর জীবিত নেই ধরে নিয়ে রীতি মেনে তার শেষকৃত্যও করেছিল পরিবার।
বিবিসি’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে গোপন বন্দিশালায় কাটানো দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন মাইকেল চাকমা। ছেড়ে দেওয়ার আগে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার রাতটিকে জীবনের অন্তিম সময় হিসেবেই ধরে তিনি।
মাইকেল চাকমা বিবিসি’কে জানান, শেষ রাতে তাকে গাড়িতে নেওয়ার সময় কিছুটা আলগা করে চোখে কাপড় বাঁধা ছিল, যেটি এক পর্যায়ে গাড়ির সিটে ঘসে ঘসে কিছুটা নামাতে সক্ষম হন এবং আজানের পর কিছুটা আলোর দেখা পান।
২০১৯ সালের পর ৬ আগস্ট ২০২৪ সালে প্রথম দিনের আলোর দেখা পান মাইকেল চাকমা। তবে তাকে যে এদিন ছেড়ে দেওয়া হবে, সেটি কল্পনাও করেননি।
মাইকেল চাকমা জানান, গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটি গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল। শুরুর দিকে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। তবে তাকে কখনো মারধর করা হয়নি। যদিও যেভাবে একাকী বন্দি করে রাখা হয় এবং যে পরিবেশে রাখা হয়, সেটি তার ভাষায় ‘অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ংকর মানসিক অত্যাচার’।
‘যেভাবে তারা রাখে, এটা অত্যন্ত অমানবিক। এটা মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। এটা কবরের মতো। গুহা আছে না, গুহায় থাকলে মানুষ যেভাবে কিছুই দেখে না, কবরে থাকলে মানুষ যে কিছুই দেখে না, ঠিক সেরকম।’
‘কোনো জানালা নেই, একদম কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না, শুধু চারিদিকে দেয়াল,’ বলেন মাইকেল চাকমা।
তিনি বলেন, কোনো কোনো রুম সাত ফিট বাই এগারো ফিট, কোনো রুম ছিল আট ফিট বাই এগারো বা বারো ফিটের। মানে একদম ছোট ছোট রুম। ওখানে একটা খাট আছে তিন ফিট বাই সাত ফিটের লোহার। কোনো জায়গায় কাঠের।
মাইকেল চাকমা জানান, এই দীর্ঘ সময়ে ঘুরেফিরে চার-পাঁচটি বন্দিশালায় তাকে রাখা হয়েছিল। এসব বন্দিশালায় আরও মানুষ আটক ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে তার সঙ্গে রাখা হয়েছিল আরও দুজনকে। এছাড়া অদেখা দুজনের নাম তিনি শুনতে পেয়েছেন। তবে এসব বন্দির ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই মাইকেল চাকমার।
মাইকেল বলেন, গোপন কারাগারে কেউ কাউকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে গোসল করতে নেওয়ার সময় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে তিনি কিছু বন্দিদের দেখেছেন।
‘বিভিন্ন বয়সের লোক। কারও দেখেছি চুল পাঁকা, দাড়ি পাঁকা। কেউ কম বয়সী। কোনও কোনও লোককে দেখেছিলাম বয়স হয়তো পঞ্চাশ-পঁয়তাল্লিশ এরকম হবে। কাউকে কাউকে দেখেছি বয়স ষাটের ওপরে। কেউ একদম ইয়াং।’
মাইকেল চাকমার সঙ্গে দুই দফায় দুজন বন্দিকে একসঙ্গে রাখা হয়েছিল। অত্যন্ত গোপনে কথা বলে তাদের পরিচয় জানতে পারেন মাইকেল। এছাড়া আরও একজনের নাম শুনতে পারেন, যিনি পাশের রুমে বন্দি ছিলেন। একসঙ্গে যাদের সঙ্গে ছিলেন তার মধ্যে একজনের নাম সাইদুল আরেকজন এরশাদ।
সাইদুলের বাড়ি ছিল রংপুরে। এরশাদের বাড়ি ছিল ঢাকার কচুক্ষেতের কাছাকাছি, সে বলেছে। সাইদুলকে যেদিন নিয়ে যায়, আমি আমার বোনের ফোন নাম্বার মুখস্ত করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, মোবাইল নাম্বারের শেষের একটি ডিজিট ভুল দিয়েছিলাম।’
মাইকেল জানান, তার পাশের সেলে জাকির নামে একজন ছিলেন বলে শুনতে পেরেছিলেন। রুমে আটক বন্দির আরেকজনের সঙ্গে কথোপকথন শুনে তাদের কোনো বাহিনীর সদস্য বলে মনে হয়েছিল।
‘ফিসফিস করে বলতো, আমি জাকির, আমি জাকির। আমার কাছে বারবার জানতে চেয়েছে, শরিফকে তুমি চেনো কি না। অন্যজনের নাম শুনিনি, তাকে স্যার ডাকতো জাকির। জাকির তাকে বলেছে, আমাদের সম্ভবত কোর্ট মার্শাল হবে।’
‘জাকিরকে একবার পিটিয়েছে। মারধর করেছে। জাকির ওখান থেকে এসে বলেছে, আমাকে আজ অনেক মারধর করেছে। ওহ পারছি না। আমার জ্বর উঠেছে। মানে তারা কথাবার্তা বলতো। তাকে ওষুধ দিতো, আমি শুনতাম। এটুকু আমি শুনেছি তাদের কথা।’
দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে মাইকেল চাকমা বলছেন, তার জীবনের এই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর যারা শেষ করে দিয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। কিছুটা সুস্থ্ ও স্বাভাবিক হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
For more information
আরো দেখুন|
Summary
Article Name
‘আয়নাঘরের’ বর্ণনা দিলেন ৫ বছর পর ফিরে আসা মাইকেল চাকমা
Description
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা...
Author
sylheterawaz
Publisher Name
sylheterawaz
Publisher Logo